
ড. মো. বায়েজিদ মোড়ল: বর্তমানে বাংলাদেশে পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই দমনের জন্য প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত বালাইনাশক কীটনাশক/ ছত্রাকনাশক/ কৃমিনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। বালাইনাশকের মাত্রারিক্ত ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন পরিবশগত ও স্বাস্থ্যগত মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিকে ব্যবহৃত বালাইনাশক সমূহের উপর সহনশীল ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় বালাই দমনে এগুলি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায়, শুধু কীটনাশকের উপর নির্ভরশীলতা পরিহার করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক, উৎপাদনকারী এবং ভোক্তার জন্য সবচেয়ে কম ক্ষতিকারক দমন ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করা হয়েছে। এক বা একাধিক বালাই দমন কৌশল বা পদ্ধতি অবলম্বন করে ফসলের ক্ষতির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব যা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা নামে পরিচিত।
বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে বেগুন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় সবজি। তবে বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণের ফলে বেগুনের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। ব্যবহৃত কীটনাশকসমূহের উপর বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার সহনশীল ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় এ পোকা দমনে প্রকৃতপক্ষে তেমন কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশে এ পোকা দমনে অত্যন্ত সহজ, কার্যকরী এবং তুলনামূলকভাবে কম ব্যয় সম্পন্ন একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করা হয়েছে।
নিম্নোক্ত তিনটি ধাপের মাধ্যেমে এ পোকা কার্যকরভাবে দমন করা যায়।
১। পোকা আক্রান্ত ডগা ও ফল ধ্বংস করা।
২। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পুরুষ পোকা স্ত্রী পোকার সাথে মিলিত হওয়ার পূর্বেই ধরে ফেলা ও ধ্বংস করা।
৩। কীটনাশকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা বা সীমিত আকারে ব্যবহার করা।
পোকা আক্রান্ত ডগা ও ফল ধ্বংস করা
ফল ধরার আগে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার কীড়া বেগুনের ডগার ভেতর খেয়ে ফেলে এবং আক্রান্ত ডগা শুকিয়ে যায়। কীড়া সমেত আক্রান্ত ডগা কেটে ধ্বংস করে ফেললে পোকার বংশ বৃদ্ধি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। সারা মৌসুমেই সপ্তাহে কমপক্ষে এক দিন বেগুনের মাঠ থেকে আক্রান্ত ডগা সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। আক্রান্ত ডগা কেটে নেয়ার ফলে বেগুন গাছের কোন ক্ষতি হয় না। উপরন্তু কাটা স্থান হতে প্রচুর পরিমাণ নতুন ডগা গজায় যা থেকে প্রচুর পরিমাণে ফুল ও ফল হয়। পোকা আক্রান্ত ডগার মত ফলও আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই সংগ্রহ করে তা ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
সাবধানতাঃ
পোকা আক্রান্ত ডগা বা ফল কোন ক্রমেই বেগুনের জমির আশেপাশে ফেলে রাখা উচিত নয়। এ ধরণের ডগা বা ফল কমপক্ষে ৩০ সে.মি. পরিমাণ গর্ত করে মটিতে পুঁতে ফেলতে হবে বা কুচি কুচি করে কেটে ফেলতে হবে। বেগুন ফসল উত্তোলন করার পর পুরাতন গাছগুলোকে সাথে সাথে পুড়িয়ে ধ্বংস করতে হবে।
সেক্স ফেরোমন ফাঁদের ব্যবহার:
* পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করার জন্য স্ত্রী মথ এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যা সেক্স ফেরোমন নামে পরিচিত। সেক্স ফেরোমন প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থ সেহেতু এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক নয়।
* দু’টি রাসায়নিক পদার্থ, ই-১১ হেক্সডেসিনাইল এসিটেট ও ই১১- হেক্সডেসিন-১ ও এল ১০ঃ১ অনুপাতে মিশ্রিত করে এটি তৈরি করা হয়। এই ফেরোমন শুধু বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পুরুষ পোকা আকৃষ্ট করতে সক্ষম।
* সূক্ষ ছিদ্র সহ প্লাষ্টিকের ছোট টিউবে ২-৩ মিলিগ্রাম পরিমাণ ফেরোমন ভরে টিউবটি একটি পোকা ধরা ফাঁদে ঝুলিয়ে রাখলে তা ৬-৮ সপ্তাহ পর্যন্ত পুরুষ মথ আকৃষ্ট করতে পারে, যা পরবর্তীতে সংগ্রহ করে ধ্বংস করা হয়। সেক্স ফেরোমন এর টিউবটি ঝুলিয়ে রেখে আকৃষ্ট পুরুষ পোকাকে আটকানো ও পরবর্তীতে মেরে ফেলার জন্য বিভিন্ন ধরনের পোকা ফাঁদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
* তিনলিটার পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ও ২২ সে.মি. লম্বা চার কোনাকৃতি বা গোলাকার একটি প্লাষ্টিকের পত্রে দিয়ে এই ফাঁদ তৈরি করা হয়। পাত্রটির উভয় পার্শ্বে ১০-১২ মে.মি উচ্চতা এবং নিচের দিকে ১০-১২ সে.মি পরিমাণ অংশ ত্রিভুজাকারে কেটে ফেলতে হবে। পাত্রের তলা হতে কাটা অংশের নিজের দিক কমপক্ষে ৩-৪ সেমি পর্যন্ত সাবান মিশ্রিত পানি ভরে রাখতে হবে। প্লাষ্টিকের পাত্রের মুখ হতে সেক্স ফেরোমনসহ প্লাষ্টিক টিউবটি একটি সরু তার দিয়ে এমনভাবে ঝুলিয়ে রাখতে হবে যেন টিউবটি পানি হতে মাত্র ২-৩ সেমি. উপরে থাকে।
* সেক্স ফেরোমন এর গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পুরুষ মথ প্লাষ্টিক পাত্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ও ফেরোমনসহ টিউবটির চারিদিকে উড়তে যেয়ে সাবান পানিতে পড়ে আটকে যায় এবং পরবর্তীতে মারা পড়ে।
* খেয়াল রাখতে হবে যেন পাত্রের তলায় রক্ষিত সাবান পানি শুকিয়ে না যায়। যতœ সহকারে ব্যবহার করলে এধরণের প্লাষ্টিক পাত্রের ফাঁদ ৩-৪ মৌসুম পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
* সেক্স ফেরোমন ভরা প্লাষ্টিক টিউবটির মুখ সব সময়ই বন্ধ রাখতে হবে।
* বেগুনের চারা লাগানোর ৩-৪ সপ্তাহ হতে শুরু করে শেষ বার ফসল উত্তোলন পর্যন্ত ফেরোমনের ফাঁদ পেতে রাখা আবশ্যক।
* ফেরোমন ফাঁদ সাধারণত ১০ মি. দূরে দূরে এবং বেগুন গাছের ঠিক পরে পাতা উচিত। বেগুন গাছ যত বড় হবে ফাঁদের উচ্চতাও সে অনুপাতে বাড়াতে হবে।
বিষাক্ত কীটনাশকের প্রয়োগ বন্ধ বা সীমিত ব্যবাহার
বাংলাদেশে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার বেশ কয়েকটি দেশীয় পরজীবী ও পরভোজী পোকা শনাক্তকরণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে পরজীবী পোকা ট্রাথালা ফ্লেভো-অরবিটাসিল উল্লেযোগ্য।
* পরজীবী স্ত্রী পোকা বেগুনের ডগা ও ফলছিদ্রকারী পোকার কীড়ার পোকার কীড়ার শরীরের ভেতর তার লম্বা নল ঢুকিয়ে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে পরাজীবী পোকর কীড়া বের হয়ে আশ্রিত পোকার কীড়ার ভেতরে খেয়ে বড় হতে থাকে। যদিও পরবর্তীতে আশ্রিত ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার কীড়া পুত্তুলিতে পরিণত হয় কিন্তু এ অবস্থাতেই এরা মারা যায় এবং পুত্তুলি হতে পরজীবী ট্রাথালা ফ্লোভো-অরবিটারিস এর পুর্ণাঙ্গ বোতলা বের হয়ে আসে।
* ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহার করা হয় এমন এলাকায় এই পরজীবী পোকা সম্পূর্ণভঅবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়্। অন্যদিকে বিষাক্ত কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার না করা বেগুনের জমিতে ট্রাথালা ফ্লেভো-অরবিটাসিল দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে। সাথে সাথে প্রচুর পরিামণে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকাও ধ্বংস করে।
* কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করলে কেবলমাত্র এ ধরণের পরজীবীই নয় বরং আরও অনেক পরজীবী ও পরভোজী পোকামাকড় যেন, ম্যনটিড এয়ার ইউগ, পিঁপড়া, লেডি বিটল, মাকড়সা ইত্যাদির সংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এধরণের পরভোজী পোকা বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষতিকারক পোকা যেমন, জ্যাসিড, সাদা মাছি, ইত্যাদির সংখ্যা স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখতে সাহায্যে করে। একান্ত প্রয়োজনে কেবলমাত্র পরিমিত মাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
* সর্বোচ্চ ফল লাভের জন্য কোন এলাকার সকল বেগুন চাষীগণকেই একত্রে উক্ত পদ্ধতিসমূহ প্রয়োগ করতে হবে।





















