
বাণিজ্যিক মুরগি খামার পরিকল্পনায় বিবেচ্য বিষয়
যে কোন খামার বা শিল্পে বাণিজ্যিক ভাবে সফলতা লাভের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা। বাণিজ্যিক মুরগি খামার ব্যবস্থাপনায় তিনটি মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হয়। যথা- ১) মুরগির খাদ্য ব্যবস্থাপনা ২) বাসস্থান ৩) রোগ দমন ব্যবস্থাপনা।
১। জমির পরিমাণ
বার্ষিক যত সংখ্যক ডিম/ব্রয়লার উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে তদনুযায়ী লেয়ার/ব্রয়লার প্রতিপালনের ঘর এবং অন্যান্য সুবিধা যেমন-অফিস, শ্রমিক ঘর, খাদ্য গুদাম ইত্যাদি তৈরির জন্য মোট জায়গার সঙ্গে আরও প্রায় ১.৫ গুণ ফাঁকা জায়গা যুক্ত করে খামারের মোট জমির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
২। মুরগির বাসস্থান
বাসস্থানের অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন-পরিমাণ মতো থাকার জায়গা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাদ্য ও পানির পাত্র, তাপ ও আলো এবং বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। পালনকারীর সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে ঘর পাকা, কাচাঁ, বা টিনের হতে পারে। প্রজাতি বা স্ট্রেইন অনুযায়ী যতগুলো মুরগি রাখা হবে এদের মোট জায়গার পরিমাণ হিসাব করে ঘর তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি দুইটি ঘরের মাঝে ২৫-৩০ ফুট বা ততোধিক জায়গা আলো ও মুক্ত বাতাস প্রবাহের জন্য খালি রাখা দরকার।

ঘর তৈরি
বাজারজাত করার বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ব্রয়লারের জন্য ১ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন। এভাবে হিসেব করে ব্রয়লার উৎপাদনের সংখ্যার উপর ভিত্তি করেই ঘরের সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। সাদা খোসার ডিম উৎপাদনকারী প্রতিটি লেয়ার মুরগির জন্য ৩ বর্গফুট জায়গা এবং বাদামি খোসার ডিম উৎপাদনকারী প্রতিটি মুরগির জন্য ৪ বর্গফুট জায়গা হিসাব করে থাকার ঘর তৈরি করতে হবে। এসব মুরগি খাঁচায়, মাচায় অথবা লিটার পদ্ধতিতে পালন করা যায়। খাঁচা পদ্ধতিতে প্রতিটি উৎপাদনশীল মুরগির জন্য কেইজে ৬০-৭০ বর্গইঞ্চি জায়গা প্রয়োজন হবে। প্রতিটি উৎপাদনশীল মুরগির জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ মাচায় ১.২-১.৩ বর্গফুট এবং লিটারে ১.৫-১.৭৫ বর্গফুট।
ঘরের চালা ও বেড়ার নমুনা
বাংলাদেশের পরিবেশে দো-চালা বা গেবল টাইপ চালাই মুরগির জন্য বেশি আরামদায়ক। লেয়ার ঘরের বেড়ার উচ্চতার পুরোটাই তারজালি দিয়ে তৈরি করতে হয়। বেশি বাতাস বা বেশি শীত হতে মুরগিকে রক্ষা করার জন্য বেড়ার ফাঁকা অংশ প্রয়োজনে ঢেকে দেয়ার জন্য চটের পর্দার ব্যবস্থা করতে হবে। দেয়ালের উচ্চতার ৬০% তার জালি দিয়ে তৈরি করতে হয়। তবে শীতের দিনে তারজালির এ অংশটুকু চটের বস্তা দিয়ে ঢাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
ডিম পাড়ার বাসা
মাঁচা অথবা লিটারে পালন পদ্ধতিতে প্রতি ৫টি মুরগির জন্য ১টি করে ডিম পাড়ার বাসা সরবরাহ করতে হয়। প্রতিটি বাসা দৈর্ঘ্য ১ ফুট ও গভীরতায় ১.৫ ফুট হওয়া প্রয়োজন । খাঁচা পদ্ধতিতে পালন করলে আলাদাভাবে ডিম পাড়ার বাসা বা বাক্স লাগে না

আলোকায়ন
লেয়ারে দৈনিক (২৪ ঘন্টায়) আলোর প্রযোজন হবে ১৬ ঘন্টা। কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা বছরের ছোট-বড় দিন অনুযায়ী দৈনিক ২.৫ ঘন্টা হতে ৪ ঘন্টা পর্যন্ত হবে। আলোর উৎস বৈদ্যুতিক বাল্ব। যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই সেখানে উজ্জ্বল হারিকেনের আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। বাল্বের শক্তি হবে ৪০ ওয়াট। আলোর রং স্বাভাবিক, আলোর তীব্রতা মৃদু (২০ লাক্স) হবে। ১টি বাল্বের আলোকায়ন এলাকা ১০০০বর্গ ফুট। বাল্ব স্থাপনের এক পয়েন্ট হতে আরেক পয়েন্টের দূরুত্ব হবে ২০ ফুট। সাধারণত প্রতি ১০ বর্গফুটের জন্য ৫ ওয়াট পরিমাণ আলোর প্রয়োজন।
উন্মুক্ত ঘর এ ধরণের ঘরে প্রাকৃতিক আলো বাতাস চলাচলের জন্য চারদিকে অথবা উত্তর দক্ষিণে উন্মুক্ত রাখা হয়।
এ ধরণের ঘরের নির্মাণ খরচ তুলনামূলকভাবে কম।
মুরগির ঘর সাধারণত পূর্ব-পশ্চিম লম্বা এবং উত্তর-দক্ষিণ দিকে উন্মুক্ত রাখা হয়। ঘরের ভিতর লিটার অথবা মাঁচা ব্যবহার করা যায়। খামারের চারিদিকে ভালোভাবে বেড়া দিতে হবে এবং উন্মুক্ত স্থান তারের জালি দিয়ে ঘিরে দিতে হবে যাতে বন্য প্রাণি এবং ক্ষতিকর পাখি খামারের ভিতর প্রবেশ করতে না পারে ।
ঘরের মেঝেতে লিটার ব্যবহার করলে ঘরের চারিদিকে খোলা অংশে এক থেকে এক ফুট ছয় ইঞ্চি (১-১.৫) ফুট উঁচু দেয়াল রাখতে হবে। মাচা বা খাচা ব্যবহার করলে দেয়াল রাখার দরকার নেই ।
দো-চালা ঘরের চালের ছাচ ৮ ফুট এবং দু’ চালের শীর্ষ দেশের উচ্চতা ১৪ ফুট উঁচু হতে হবে । ছোট ঘর হলে চালের ছাচ ৬ ফুট এবং দু’ চালের শীর্ষ দেশের উচ্চতা ১২ ফুট উঁচু করতে হবে। বৃষ্টির পানি ঘরে যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য চালের ছাট ২.৫-৪.০ ফুট বাড়তি রাখতে হবে।
ঘরের প্রসস্থ্যতা ৩০ ফুটের বেশি হলে ভেন্টিলেশনের সমস্য হয়।
খামারের একাধিক শেড থাকলে পরস্পর শেডের দুরত্ব কমপক্ষে শেডের প্রস্থ্যের ১.৫ গুণ হওয়া প্রয়োজন ।
ঘরের মেঝে ইঁদুর প্রতিরোধক হওয়া উচিত। প্রতিটি মুরগির জন্য ১-২ বর্গ ফুট জায়গা হিসাব করে ঘর নির্মাণ করা উচিৎ।
পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত ঘর
মুরগির স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখে ঘরের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও আলোক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের সুবিধাজনক ঘরকে পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত ঘর বলে। এ ধরণের ঘরে মুরগি ভালো থাকে। পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত ঘরে পানি ও খাদ্য ব্যবস্থা যান্ত্রিকভাবে করা হয়। পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত ঘরের ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা জরুরি, অন্যথায় মুরগি মারা যেতে পারে।

খামার ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার হিসাব খামার ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার খরচ দু’ভাগে বিভক্ত।
স্থায়ী খরচ স্থায়ী খরচের খাত-ওয়ারী হিসেবে নিম্নরূপ-
খামারভুক্ত জমির মূল্য এলাকা অনুযায়ী প্রতি বিঘা জমির মূল্য কমবেশি হয়ে থাকে।
মুরগির গৃহায়ণ ব্যবস্থা বাবদ খরচ ঘর তৈরির সাজ-সরঞ্জাম বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যথা-বাঁশ, টিন বা বিচালী, মাটির ঘর, ইট, সিমেন্ট বা পাকা দালান ঘর। ঘর তৈরির সাজসরঞ্জাম অনুযায়ী প্রতি বর্গফুট ঘর তৈরির খরচ, তা যেভাবেই ঘর তৈরি করা হোক না কেন প্রতি বর্গফুট হিসেবে খরচ ধরে ঘরের মোট খরচ বের করতে হবে।
ম্যানেজারের অফিস, ডিম/মাংস সংরক্ষণাগার,খাদ্যগুদাম, খাদ্য ছাড়া অন্যান্য জিনিসপত্র রাখার স্থান, শ্রমিকদের বিশ্রাম ঘর, অসুস্থ ও মৃত মুরগি রাখার জায়গা নির্মাণ বাবদ খরচ। আসবাবপত্র ক্রয় বা তৈরি ও যানবাহন ক্রয় বাবদ খরচ, খাবার ও পানির পাত্রের দাম, ডিম পড়ার বাক্সের দাম ও ডিম রাখার ঝুঁড়ি কেনার জন্য খরচ।
আবর্তক বা চলমান বা চলতি খরচ ঃ আবর্তক খরচের খাত-ওয়ারী হিসেব নিম্নরূপ-
মুরগি সংক্রান্ত খরচ ডিমের ব্যবহার অনুযায়ী ডিমপাড়া মুরগির খামার দু’প্রকার। যথা- নিষিক্ত বা বাচ্চা ফুটানোর ডিম উৎপাদন খামার এবং অনিষিক্ত বা খাবার ডিম উৎপাদন খামার। খাবার সাদা বা বাদামি খোসার ডিম বা বাচ্চা ফুটানোর ডিম উৎপাদনকারী মুরগি বা বাচ্চা কোথায় পাবেন, আপনি সেগুলো আনতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারের নিশ্চিত হতে হবে। নিষিক্ত ডিম বা ডিমের জন্য প্রজননক্ষম পুলেট ও ককরেলের মূল্য, অ-নিষিক্ত বা খাওয়ার ডিম উৎপাদনের জন্য উন্নতমানের হাইব্রিড পুলেটের মূল্য অথবা একদিন বয়সের ব্রয়লার বাচ্চা ক্রয়ের খরচ।
সুষম খাদ্যের মূল্য মাথাপিছু দৈনিক গড় ১১০-১২০ গ্রাম হিসেবে মোট খাদ্য ক্রয়ের খরচ।
লিটার কেনা বাবদ খরচ খাঁচায় মুরগি পালন করলে মেঝে পাকা হলেই ভালো।
টিকা ও ঔষধ ক্রয়ের খরচ প্রতিষেধক টিকা এবং চিকিৎসায় ঔষধ-পত্রের মূল্য।
কর্মচারীদের বেতন বাবদ খরচ খামার পরিচালনায় জনবলের বেতন ভাতা খরচ, ম্যানেজারের বার্ষিক বেতন ভাতা, অফিস স্টাফের বার্ষিক বেতন ভাতা ও শ্রমিকদের বার্ষিক বেতন ভাতা ।
পরিবহন ও যাতায়াত খরচ বিভিন্ন কাজে ম্যানেজারের যাতায়াত খরচ এবং খাদ্য সংগ্রহ, ডিম বাজারজাতকরণ ও ডিমপাড়া শেষে মুরগি বিক্রির জন্য পরিবহন খরচ।
মূলধনের সুদ ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে মূলধনের উপর বার্ষিক সুদ।
অপচয় খরচ জমিবাদে স্থায়ী খরচের অপচয়ের শতকরা হার ইত্যাদি যত খরচ হয় সব যোগ করে বার্ষিক খরচ/মোট খরচের হিসেবে রাখতে হবে। মেরামত খরচ ও বিদ্যুৎ ও পানির বিল বাবদ খরচ। এডভারটাইজিং বা বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ। নষ্ট বা বাদ যাওয়া ডিমের মূল্য, ডিম বাছাই ও ছাটাই খরচ, যতগুলো ডিম বিক্রির অনুপযুক্ত হলো তার মূল্য। অসুস্থ বা মৃত মুরগির মূল্য।
খামার হতে সম্ভাব্য বার্ষিক আয় ঃ
ডিম বিক্রি লেয়ার খামারের ক্ষেত্রে বার্ষিক গড়ে ৭০-৭৫% হারে উৎপাদন ধরে বর্তমান বাজার দরে ডিমের মোট মূল্য।
ডিম পাড়া শেষে মুরগির মূল্য শতকরা ৮৮ টি মুরগি সুস্থ অবস্থায় বেচেঁ থাকার ক্ষমতা আছে এ হিসেবে ডিম পাড়া শেষে বাজার দরে মোট মূল্য। ব্রয়লার খমারের ক্ষেত্রে গড়ে ৪ সপ্তাহ পর পর মাংসের জন্য মুরগি বিক্রি। প্রতিটি মুরগি থেকে বছরে প্রায় ৩০ কেজি বিষ্ঠা পাওয়া যেতে পারে। এভাবে হিসেব করে বর্তমান বাজার দরে মোট বিষ্ঠা বা সারের মূল্য। অকেজো আসবাবপত্র বিক্রি বাবদ মূল্য। খামার হতে বার্ষিক কত টাকা লাভ হতে পারে তা নির্ধারণ করতে হবে। অনুমেয় অর্থ মুনাফা করতে হলে খামার জাত পণ্য হতে শতকরা ১০-১২ টাকা হারে লাভে মোট কত টাকা আয় হতে পারে তা হিসেবে করতে হবে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিস্কার হবে। যেমন- বার্ষিক গড়ে ৭০-৭৫% হারে খাবার ডিম বা অ-নিষিক্ত ডিম উৎপাদন এবং ৬০-৬৫% হারে বাচ্চা ফুটানো বা নিষিক্ত ডিম উৎপাদন ধরে, প্রতিটি ডিম গড়ে ৬-৭ টাকা হিসেবে বিক্রি করা গেলে এবং বছর শেষে ৮৮% মুরগি নীঃরোগ ও স্বাস্থ্যবান থাকলে আর অবশিষ্ট অনু-উৎপাদনশীল মুরগি বিক্রয় করে উৎপাদন খরচ বাদে ১০-১২% লাভ থাকবে। এ জাতীয় হিসেব করে পরিকল্পনা করতে হবে। এভাবে মোট আয় থেকে মোট ব্যয় বাদ দিয়ে প্রকৃত লাভ-লোকসান নির্ধারণ করতে হবে। উপরোক্ত বিষয়সমূহ ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে খামার স্থাপনের পরিকল্পনা করা উচিত।





















